গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় টেস্ট।

গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় টেস্ট কি কি তা নিয়ে আজকে আলোচনা করা হবে। সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার গর্ভাবস্থা মা ও অনাগত শিশু উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মা ও শিশুর বৃদ্ধি, কোনো জন্মগত ত্রুটি হচ্ছে কিনা বা আছে কি না, মার থেকে শিশুর মধ্যে কোনো রোগ সংক্রমিত হচ্ছে কিনা, শিশুর থেকে মায়ের মধ্যেও কোনো রোগ যেতে পারে কি না এসব জানা জরুরি।

গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় টেস্ট।


ভূমিকাঃ

ঋতু স্রাবের অনুপস্থিত সব মহিলাদের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে। এটি আপনাকে গর্ভধারণ নিশ্চিত করার জন্য গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করতে পারে। মহিলারা প্রায়ই গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করার সঠিক সময় সম্পর্কে বিভ্রান্ত হন। বেশিরভাগ স্বনামধন্য ব্র্যান্ড পিরিয়ড মিস হওয়ার প্রথম দিন আগেও সঠিক ফলাফল দেওয়ার দাবি করে।

যাইহোক, একটি নিশ্চিত ফলাফলের জন্য একটু অপেক্ষা করা ভাল। এই পরীক্ষার কিটগুলি গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে আপনার প্রস্রাবে গর্ভাবস্থার হরমোন হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন (HCG) এর উপস্থিতি মূল্যায়ন করে।  

প্রথম তিন মাসের টেস্টঃ

প্রেগনেন্সি টেস্ট বা গর্ভধারণ হওয়ার টেস্ট মাসিক বন্ধের এক সপ্তাহ পরে কোন মহিলা গর্ভধারণ করলে প্রস্রাবের মধ্য দিয়ে নির্গত হরমোন বিটা HCG- এর উপস্থিতির কারণে এ টেস্ট পজিটিভ হবে। প্রস্রাব ছাড়াও রক্তরস বা সিরাম দিয়ে এই টেস্ট করা যায়। পজিটিভ হলে বুঝতে হবে গর্ভধারণ হয়েছে।

রক্তের শর্করা বা সুগার টেস্টঃ

এটাও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা। OGTT টেস্ট খালি পেটে বা গ্লুকোজ খাওয়ার দু'ঘণ্টা পর সুগার টেস্ট করতে হবে। ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা করাতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে পেটের বাচ্চা বড় হবে, প্রসবের সময় জটিলতা দেখা দেবে এবং পরবর্তী গর্ভধারণের সময় আবার ডায়াবেটিস হবে। 

রক্তের কিছু সাধারণ পরীক্ষা যেমন হিমোগ্লোবিন, টিসি, ডিসি, ইএসআর ইত্যাদির মাধ্যমে রক্তস্বল্পতা আছে কিনা বা কোনো ইনফেকশন আছে কি না, তার প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় এবং এসবের ভিত্তিতে চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

রক্তে লিপিড প্রোফাইল বা চর্বির পরিমাণ দেখাঃ

অভুক্ত অবস্থায় যে কোনো ভাল ল্যাব থেকে এ পরীক্ষা করা যাবে। এর ফলে চর্বির কোন অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা নির্ণয় করা সম্ভব। রক্তে যৌনবাহিত রোগ যেমন সিফিলিস, গণরিয়া, এইডস, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি নির্ণয় করা প্রয়োজন। এ রোগ ভয়ংকর এবং এটা বাচ্চার মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। বাচ্চা নষ্ট এবং মৃত্যুরও হতে পারে।

আল্ট্রাসনোগ্রামঃ

গর্ভাবস্থাকালীন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা। গর্ভধারণের ৭-৮ সপ্তাহের মধ্যে এ টেস্ট করে বাচ্চার অবস্থান, জীবন নিশ্চিত করা হয়। যদি কারো ডিম্ববাহী নালী বা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ হয়ে থাকে তাহলে তার গর্ভাবস্থা আর অগ্রবর্তী না করাই ভাল কারণ গর্ভধারণ থাকবে না এবং এর জন্য পরবর্তীতে রক্তক্ষরণ হয়ে বাচ্চা বের হয়ে যাবে। অর্থাৎ অ্যাবরসন হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ভাল কোনো সনোলজিস্ট দিয়ে ভাল একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে এ পরীক্ষা করাতে হবে।

দ্বিতীয় তিন মাসের প্রয়োজনীয় টেস্ট চিকিৎসকের পরামর্শে আল্ট্রাসনোগ্রাম। এটা গর্ভস্থিত শিশুর বৃদ্ধি, আকার আকৃতি, পজিশন, গর্ভ ফুলের অবস্থা, শিশুর ওজন, পানির পরিমাণ ইত্যাদি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মাথা বড় হচ্ছে কি না, পানি জমছে কি না বা হাইড্রোকেফালাস নির্ণয়ে এ টেস্ট প্রয়োজনীয়। এছাড়া মোলার প্রেগনেন্সি দেখার জন্যও এই টেস্ট জরুরি। রক্তের রুটিন পরীক্ষা হেমোগ্লোবিন টিসি-ডিসি ইএসআর করে রক্ত স্বল্পতা নির্ণয়, যে কোনো প্রদাহ নির্ণয় এর জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা।

প্রস্রাব ও পায়খানা রুটিন পরীক্ষাঃ

কোনো প্রদাহ আছে কি না, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের কারণে প্রস্রাবে বেশি প্রোটিন বা সুগার যাচ্ছে কি না এটা দেখা গর্ভবর্তী মায়ের জন্য জরুরি। মা ও গর্ভস্থ শিশুর ব্লাড গ্রুপ ও আরএইচ জানা গেলে মা এর থেকে রক্ত নিয়ে এবং বাচ্চার কর্ড ব্লাড নিয়ে এ টেস্ট করা যায়। 

যদি উভয়েই পজিটিভ হয় তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু মা RhD পজিটিভ ও বাচ্চা RhD নেগেটিভ হলে পরবর্তী গর্ভাবস্থায় বাচ্চার রক্তপাত এবং মৃত্যুরও হতে পারে। এ জন্য মাকে এটা প্রতিরোধের জন্য এন্টি RhD ইনজেকশন নিতে হবে।

জেনেটিক রোগ নির্ণয়ঃ 

যে কোনো গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় টেস্ট হলো জেনেটিক বা ক্রোমোজোমাল স্টাডি। সাধারণত অনাগত শিশু সুস্থ হবে কিনা, কোন বংশগত রোগ, প্রাণসংহারী রোগ, নিরাময় অযোগ্য রোগ যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এগুলো নির্ণয়ের জন্য জেনেটিক স্টাডি এবং ক্রোমোজোমাল স্টাডি করানো গুরুত্বপূর্ণ। 

সাধারণত গর্ভের শিশুর নাড়ি ফুল থেকে রক্ত নিয়ে, এমনিওটিক ফ্লুয়িড নিয়ে এ ধরনের জেনেটিক বা ক্রোমোজোমাল টেস্ট করা হয়ে থাকে। এ জন্য বিশেষায়িত রোগ নির্ণয় কেন্দ্র বা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে এ পদার্থ বের করে আনা হয়। এ টেস্ট ব্যয়বহুল। 

ক্রোমোজোমাল স্টাডি করে বাচ্চার লিঙ্গ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। জেনেটিক স্টাডি করে বিকলাঙ্গ শিশু, মাথার মধ্যে পানি জমে বড় হওয়া, অন্যান্য জন্মগত ত্রুটি যেমন- স্পাইনাবাইফিডা,মাইলোসিল, স্ফিংগোমাইলোসিল ইত্যাদি রোগ নির্ণয় করা যায়।

হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিসঃ 

এর মাধ্যমে প্রাণঘাতি রোগ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা সম্ভব। এ রোগ নির্ণিত হলে গর্ভধারিণী তার স্বামীর ও পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, এই বাচ্চা তিনি নেবেন কিনা। এ ধরনের জেনেটিক ও ক্রোমোজোমাল টেস্ট বিশেষত যারা বেশি বয়সে মা হচ্ছেন, যাদের বংশগত রোগ আছে তাদের জন্য করানো গুরুত্বপূর্ণ।

রক্তে শর্করা পরীক্ষা এবং HbA1c টেস্টঃ

রক্তে শর্করা পরীক্ষা এবং HbA1c ডায়াবেটিস এর অবস্থা দেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্রাবে প্রোটিন আছে কি না এগুলো দেখার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা। BHCG বিটা হিউমান কোরিওনিক গোনাডোট্রফিক হরমোনের পরিমাণ নির্ণয়।

এটা গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট। বিশেষত মোলার প্রেগনেন্সি হলে মা বলবেন বা চিকিৎসক দেখবেন যে জরায়ুর উচ্চতা মাসিক বন্ধ হওয়ার সময়কাল থেকে সাধারণ গর্ভাবস্থা থেকে বেশি হবে। শেষ ৩ মাসের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা হিসেবে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে বাচ্চার অবস্থা ও বাড়ন্ত বাচ্চার অবস্থা, পানির পরিমাণ, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি জানা যাবে। রক্তে সুগার দেখার জন্য অভুক্ত অবস্থায়, খাওয়ার দু'ঘণ্টা পর এবং HbA1c টেস্ট করাতে হবে।

আইওএনএ (IONA) টেস্ট ঃ

গর্ভাবস্থায় কারা আইওএনএ (IONA) টেস্ট করাবেন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ ভ্রুণের ডাউন সিনড্রম অথবা অন্যকোনো জেনেটিক রোগের আশঙ্কা চিহ্নিত করতে স্ক্রিনিং করা

গর্ভাবস্থার ১০ সপ্তাহ থেকে

✓ গর্ভে শিশু একটি না একাধিক তা জানতে

✔ আইভিএফ (IVF) দাতার ডিম্বানু অথবা সারোগেট গর্ভাবস্থা

যেসব মায়েরা অনুপযুক্তঃ

☑ যারা অন্যের অঙ্গ-প্রতঙ্গ শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন।

☑ ক্যান্সার রোগী

☑  যাদের ক্রোমোজোমাল ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।

☑ গর্ভধারণের আগের বছর যারা বহুবার রক্ত নিয়েছেন

☑ যাদের শরীরে পূর্ণ অথবা আংশিক মনোসোমি এক্স (টার্নার'স সিনড্রম) রয়েছে

গর্ভাবস্থায় শিসার প্রভাবঃ

লিড বা শিসা এক ধরণের টক্সিন যা গর্ভাবস্থায় নারী এবং তার গর্ভস্থ শিশুর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ ঘটায়। শিসার বিষাক্ততায় গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত হতে পারে। সময়ের আগেই গর্ভস্থ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম হতে পারে এবং ওই শিশু জন্মের পর তার বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হতে পারে।তবে সুখবর হলো- শিসার বিষাক্ততা প্রতিরোধযোগ্য।

শিসার বিষাক্ততায় সময়ের আগেই গর্ভস্থ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম হতে পারে

শিসার বিষাক্ততার প্রভাবে শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে।

শিসার বিষাক্ততার প্রভাবে শিশুর কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষতি হতে পারে

শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে বাতাস থেকে শিসার বিষাক্ততা শরীরে প্রবেশ করে। অথবা শিসার দুষনে যেসব খাবার খাওয়া হয় তা থেকে শিসার বিষাক্ততা শরীরে প্রবেশ করে। কয়েকটি সহজ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ শিশু সুরক্ষিত হতে পারে

কি করবেনঃ

শিসার সান্নিধ্যে কখনো এসে থাকেন তাহলে ডাক্তার দেখান

১৯৭৮ সালের আগে নির্মিত বাড়ি, রংচটা দেয়াল বা মেরামতের জিনিস এড়িয়ে চলবেন

ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি ও আয়রণ সমৃদ্ধ নানা খাবার খাবেন

বাড়ির জানালা, দরজা গ্রিল এবং অন্যান্য স্থা ধুলা দূর করতে ভেজ কাপড় ব্যবহার করুন

যদি কেউ শিসার উপস্থিতির কোনো কাজ করে থাকেন, তাহলে তাকে গোসল করে এবং কাপড় পরিবর্তন করে বাসায় ঢুকতে দিন আপনার শিশুর সুরক্ষার স্বার্থে

কি করবেন নাঃ

কিছু প্রসাধনী, খাবার এবং মসলায় যেমন- হলুদে শিসার উপস্থিতি থাকে- তা পরিহার করুন।

কিছু কিছু পাত্রে বা সিরামিক সামগ্রীতে শিসাভিত্তিক রং ও ঔজ্জ্বল্যের উপস্থিতি থাকে, তাই এগুলো পরিহার করুন।

মাটির পাত্রে অথবা ময়লাযুক্ত পাত্রে থাকা কোনো খাবার খাবেন না। এগুলোতে শিসার উপস্থিতি থাকে।

শিসার উপস্থিতি আছে এমন কিছুতে পানি নিয়ে পরিষ্কার করতে যাবেন না।

যদি কেউ রং, বার্নিশ বা নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট থাকেন তার শরীরে ও পোশাকে শিসার উপস্থিতি থাকতে পারে। তা এড়িয়ে চলুন।

নারী ও হৃদরোগের সম্পর্কঃ

গর্ভাবস্থায় কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা যা কিনা হৃদযন্ত্রের সমস্যা হিসেবে সংকেত দিতে পারে নারীদের মধ্যে সবচেয়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন, যাদের মধ্যে নিচের উপসর্গগুলো রয়েছে........

গর্ভাবস্থায় যাদের উচ্চ রক্তচাপ, প্রিএক্লেম্পশিয়া অথবা এক্লেম্পশিয়ার উপসর্গ রয়েছে।

গর্ভাবস্থায় যাদের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।

গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের আগে বাচ্চা প্রসব হয়ে গেলে।

গর্ভাবস্থায় যাদের শরীরে ওজন বেড়েছে- তারা চেষ্টা করবেন বাচ্চা প্রসবের ১২ মাসের মধ্যে ওজন কমাতে। এতে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে।

আপনি যা করতে পারেনঃ

আপনার গর্ভধারণ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা থেকে থাকলে আপনার ডাক্তারকে নিশ্চিত করুন।

আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি কতটুকু তা  জানার ও বোঝার চেষ্টা করুন।স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের অভ্যাস যথা-  প্রতিদিন ব্যয়াম, হৃদযন্ত্রবান্ধব খাবার ও স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখবেন।

- প্রফেসর ডা. মালিহা রশীদ।

শেষকথা

আশা করি গর্ভাবস্থায় কি কি টেস্ট করাতে হবে এবং গর্ভাবস্থায় কি কি খাবার ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা বুঝতে পেরেছেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বন্ধুমহল আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url